সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। 'বিদ্যারম্ভে বৃহস্পতি' -এই বাক্যে বাবার বোধহয় খুব আস্থা ছিল সেজন্য আমার পাঠশালার মাস্টার মহাশয়ের (৩/পরিমল দে) সাথে আমাকে এই স্কুলে পাঠালেন ভর্তি করার জন্য। বর্তমান ১৭নং ঘর ই ছিল অফিস এবং স্টাফরুম। ওখানে আমার মৌখিক পরীক্ষা নিলেন সুধাকর গড়াই (প্রধান শিক্ষক) মহাশয় এবং (শিক্ষক) মহাশয়। অরিন্দম রায় আমাকে ভর্তি (১৯৫৫ সাল) করে নিলেন পঞ্চম শ্রেণীতে এবং পরদিন হতে ক্লাসে আসতে বললেন। আমিও মালডাঙ্গা আর, এম, ইন্সটিটিউশন-এ পড়তে শুরু করলাম। বেশ আনন্দ, উদ্দীপনা ও উৎসাহের সঙ্গে আমার পড়াশোনা চলতে লাগল। মাস্টার মহাশয়দের স্নেহ ছায়ায়, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্তিতা এবং স্কুলের রীতি-নীতির মধ্যে বাড়তে লাগলাম।
তখন বিদ্যালয় গৃহের এই রকম অবস্থা ছিল না। পূর্বের এবং পশ্চিমের কোরোগেটের ছাউনী ঘরগুলিতে ক্লাস হত। উত্তরদিকে টালির ছাউনী ঘরে তখন প্রাথমিক বিভাগ (চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত) এর ক্লাস চলত-বর্তমানে এ. খাঁপুর গ্রামে স্থানান্তরিত। ছাত্রাবাস ছিল-বর্তমানে কাদম্বিনী বালিকা বিদ্যালয়' এর স্থানে বিদ্যালয়ে শিক্ষক মহাশয়ের সংখ্যা তখন নয়জন। করণিক তো ছিলই না। প্রথম পিরিয়ডের শিক্ষক মহাশয়েরা বেতনাদি আদায় করতেন। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী বলতে আমাদের সকলের প্রিয় পটল দাদা। ঐ বৎসরেই বিদ্যালয়ে এলেন ৬ সুবোধ কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় (সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে)। প্রধান শিক্ষক মহাশয় ও সহকারী প্রধান শিক্ষক মহাশয় এর ঐকান্তিক চেষ্টায় বিদ্যালয়ে এলেন আরও নূতন নূতন শিক্ষক মহাশয়। বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন চলল কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে। অবশ্য দু'এক জন বিদ্যালয় হতে চলেও গেলেন অন্যত্র। শিক্ষক মহাশয়েরা শিক্ষকতাকে যেন ব্রত হিসাবে নিয়ে-ছিলেন। তাই তাঁদের সংস্পর্শে যা পেয়েছি তা পরবর্তীকালে আমাকে সুপথে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
ইতিমধ্যে বিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা বেড়েছে। শিক্ষক মহাশয়দের সংখ্যাও বেড়েছে। তাই, বিদ্যালয় গৃহ সম্প্রসারিত হল আমার অষ্টম শ্রেণী-তে পড়ার সময়। বর্তমানে ১৩, ১৪, ১৫ ও ১৬ নম্বর ঘর ঐ সময়ে তৈরী হয়। দশম শ্রেণীতে ক্লাস চলার কিছু দিন পর হ'তে আমাদের বেলা দশটা হতে এগারোটা এবং চারটা হ'তে সাড়ে চারটা-তে কোচিং ক্লাসে যোগ দেওয়া বাধ্যতা-মূলক ছিল। এছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে 'হোমটাস্ক' এর খাতা মাস্টার মহাশয়দের জমা দিতে হ'ত বা তাঁরা সংশোধন করে দিতেন। গরীব ছেলেদের প্রতিও শিক্ষক মহাশয়েরা যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ছিলেন-এ ব্যাপারে বিদ্যালয় হ'তে অনেকে পুস্তক ও আর্থিক সাহায্য পেত বিদ্যালয় হতে। দশম শ্রেণী শেষে ফাইনাল পরীক্ষা (তখনকার স্কুল ফাইনাল) দিতে যেতে হত মেমারী পরীক্ষা কেন্দ্রে। আমরা গ্রামের ছেলে, ভয় ও উৎকণ্ঠার মধ্যে মেমারীর মত আধা শহরে গিয়ে আমাদের অনেকেরই মজার মজার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যেমন কেউ কেউ টেলিফোন ও বৈদ্যুতিক পোস্টের প্রচুর তার টাঙানো দেখে, কেউবা বৈদ্যুতিক ট্রেন দেখে অবাক হয়। আমার এক সহপাঠী তো স্যানিটারী পায়খানা ব্যবহারে অসুবিধা বোধ করায় পরীক্ষা চলাকালীন পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে উন্মুক্ত পরিবেশে প্রাকৃতিক কাজ সারতে যায়। এবং পরীক্ষা কেন্দ্রে পুনরায় প্রবেশের সময় বাধা পায় এবং আমাদের মাস্টার মহাশয়দের চেষ্টায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পায়। প্রতি বছরে শেষ প্রাক্ পরীক্ষা দিতে নিকট দূর হতে ছাত্র-ছাত্রীরা আসায় আমাদের ছুটি থাকত এবং মজা ও পেতাম।
বিদ্যালয়ে ঐ সময় পড়াশোনা ছাড়াও খেলা-ধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চাও ছিল। বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে সরস্বতী পূজার সময় পূজার দিন উচু ক্লাসের ছাত্রদের ব্যবস্থাপনায় বিদ্যালয়ে পুজায় যোগদানকারী ছাত্রদের খাওয়ানোর ব্যাপারটা আমার বেশ মনে পড়ে। এছাড়া স্থানীয় কিছু লোকের উদ্যোগে ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পর-দিন আয়োজিত হ'ত বিরাট মহোৎসবের-যেখানে বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাড়াও শত শত জন-সাধারণ আহার করে যেত।
এরপর আমার কলেজ জীবনের পড়া শেষ করে (শারীরিক অসুস্থতার কারণে দু'বছর পড়া বন্ধ রাখতে হয়) বিদ্যালয়ে Bio-Science এর শিক্ষক হিসাবে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাই ইং-১৯৬৬ সালে। এর আগেই বিদ্যালয়ে উত্তর অংশের ব্লকটার একতলা (অর্থাৎ বর্তমান ৫, ৬, ৭, ৮ নং ঘর) তৈরী হয় এবং আমার শিক্ষকতা কালে দ্বিতলের ঘরগুলি (অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪ নং) তৈরী হয়। ইতিমধ্যে স্কুল তো একাদশ শ্রেণীতে উন্নীত হয়-বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বিভাগ সহ। আমার মাস্টার মহাশয়দের সাহচর্যে আমি শিক্ষক হিসাবে কাজ চালিয়ে যাই।
ঐ সময় খুব অসুবিধার মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান বিভাগের পঠন-পাঠন চালাতে হতো। 'সায়েন্স ল্যাবরেটরী' বলতে এখনকার ৯ নং ঘরে তিন বিভাগেরই ক্লাস করতে হতো। ইতিপূর্বে (১৯৬৩ সালে) আমাদের বিদ্যালয় হতে শ্রী রবীন্দ্রনাথ রজক স্কুল ফাইনালে সপ্তম স্থান অধিকার করে বিদ্যালয়কে গৌরবান্বিত করেছে। বিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধির সাথে দূর দূরান্ত হতে ছেলেরা আসতে লাগল পড়ার জন্য। ছাত্রাবাস বিদ্যালয়ের পূর্ব দিকে নূতন গৃহে স্থানান্তরিত হয়েছে। কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স, ও বায়োলজি ল্যাবরেটরী পৃথক পৃথক জায়গা পেল এবং স্বয়ং সম্পূর্ণ হল। প্রথম বৎসরেই উত্তীর্ণ ছাত্রদের মধ্যে ডাক্তারী ও উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেল কয়েক জনই এবং এর পরে পরে আরও অনেক কৃতী ছাত্র বিদ্যালয় হতে উত্তীর্ণ হয়ে জীবনে বিভিন্ন দিকে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সুশৃঙ্খল ও সুন্দর পরিবেশে বিদ্যালয় ক্রমশঃ আরও উন্নতির পথেই অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু ক্যান্সার রোগে মৃত্যু কেড়ে নিল বিদ্যালয়ের প্রাণ পুরুষ প্রধান শিক্ষক শ্রীয়ুক্ত সুধাকর গড়াই মহাশয়কে। এটা বিদ্যালয়ের পক্ষে একটা বিরাট শূন্যতা এবং বিপর্যয়। সহকারী প্রধান শিক্ষক শ্রীয়ুক্ত সুবোধ কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় এগিয়ে নিয়ে চললেন বিদ্যালয়কে অন্যান্য শিক্ষক মহাশয়ের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা নিয়ে।
বিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও বিভিন্ন সহপাঠক্রমিক বিষয় সমূহ যে ক্রমোন্নতির পথে এগোচ্ছিল তা আরও গতি পেল বর্তমান প্রধান শিক্ষক শ্রীয়ুক্ত নিমাই চরণ মণ্ডল মহাশয়ের উপস্থিতিতে। বিদ্যালয়ে ১০+২ অর্থাৎ টুয়েলভ ক্লাস চালু হল-বিজ্ঞান, কলা ও বাণিজ্য বিভাগ নিয়ে। তৈরী হল বর্তমান এইচ, এস, বিল্ডিং। নূতন নূতন আরও শিক্ষক এলেন। প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের নিরলস প্রচেষ্টায়, সহ প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের ও অন্যান্য শিক্ষক মহাশয়ের সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টায় বিদ্যালয়ের সুনাম আরও ছড়াতে লাগল। ১৯৯৩ সালে এইচ, এস (বিজ্ঞান) পরীক্ষায় শ্রী শ্যামা প্রসাদ মণ্ডল ১৯তম স্থান অধিকার করে বিদ্যালয়কে আরও গৌরবো উজ্জ্বল করল।
অগণিত কৃতী ছাত্রছাত্রী এই বিদ্যালয়ে পাঠ শেষ করে পরবর্তী জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে-হয়েছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, অধ্যাপক, শিক্ষক, সরকারী অফিসার ইত্যাদি। প্রতি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উল্লেখযোগ্য স্থান লাভ করে কেউ কেউ ভারত সরকার এর সহায়তায় বিদেশ গেছে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার জন্য।
বিদ্যালয় হতে অনেকে অবসর নিয়েছেন। অনেকে লোকান্তরিত হয়েছেন, অতি সম্প্রতি আমাদের মাস্টার মহাশয় ও প্রাক্তন সহকারী প্রধান শিক্ষক শ্রীয়ুক্ত সুবোধ কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় এরও প্রয়াণ ঘটল। পুরাতনরা চলে গিয়ে নূতন-জায়গা করে দেয় এটাই নিয়ম। অনুজ প্রতিম উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষকবৃন্দ, শিক্ষিকা ও অশিক্ষক কর্মীদের সতর্কতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই এই বিদ্যালয়ের উত্তোরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটবে এমত আশা রাখি।
বর্তমানে ফলে ফুলে পল্লবিত এই বিদ্যালয় এর সূচনা হয়েছিল ৫০ বৎসর আগে স্থানীয় কিছু উৎসাহী শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের চেষ্টায়। বিদ্যালয় এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক মধুর, নিবিড়, দীর্ঘদিনের ও অবিচ্ছেদ্য। এই বিদ্যালয় আমাকে শিক্ষা দিয়ে বড় করেছে। আমাকে শিক্ষক করে শিক্ষা দান ব্রতে ব্রতী হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে এবং আমার গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করেছে। শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আন্তরিক ভাবে সচেষ্ট ছিলাম এবং এখনও আছি তবে, আমার শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্য আমাকে হয়ত আর বেশি দিন এ সম্পর্ক রাখতে দেবে না-সরিয়ে নেবে এখান হতে। তবু মন বলে আমি যেন বিদ্যালয়ের সান্নিধ্যে আসতে পারি- আবার যদি ফিরি।