১৯৪৮ সাল। তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। অরিন্দম রায় নাম লিখে নিলেন। উনি ছিলেন স্কুলের শিক্ষক আবার করণিকও। প্রথম প্রিয়ডে ক্লাস রুমে বসেই বেতন আদায় করতেন। স্কুলের প্রাণ প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে উনি ছিলেন অন্যতম। উনার হাতের লেখা ছিল মুক্তোর মত। গুণমুগ্ধ পাগলবাবু (অনাদি প্রসাদ মণ্ডল, সম্পাদক) একটি পার্কার পেন (সেযুগের সেরা পেন) উপহার দিয়েছিলেন। ছাত্র দরদী এই শিক্ষক পরে আমার সহকর্মীও হয়েছিলেন।
ফুলগ্রামের কার্ত্তিক যশ মহাশয়ও আমাদের শিক্ষক ছিলেন। মালডাঙ্গা পোষ্ট অফিসের দায়িত্বও তিনি পালন করতেন ॥ খুব স্নেহ করতেন আমাদের। দেনুড়ের ধরণীধর বসু ছিলেন আমাদের পণ্ডিত মশাই। দীর্ঘ দেহী ও সুঠাম গৌরবর্ণ পণ্ডিত মশাই ছিলেন ছাত্রপ্রিয়।
ভোজপুরের কাজি আবদুল রহমান তখন বিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষক। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রদের পড়ানোর দায়িত্বে ছিলেন তিনি। স্থানাভাব ও ছাত্র সংখ্যা কম থাকায় একই কক্ষে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ক্লাস হোত। (তৃতীয় শ্রেণীই ছিল বিদ্যালয়ের সর্বনিম্ন শ্রেণী) আমাদের পরম সৌভাগ্য রহমান সাহেব আজও জীবিত। শুশুনার (অধুনা তারাশুশুনা) দুর্গাদাস মুখার্জী প্রাথমিক শ্রেণীতে পড়ানোর দায়িত্বে ছিলেন। কবি প্রকৃতির মানুষ। -ওঁর লেখা কবিতার একটি লাইন
"একপো দুধে পাঁচপো পানি ও আমার খুদু গোয়ালিনী”।
১৯৫০-৫১ সালে মন্তেশ্বর নিবাসী দাশরথি রায় এবং মেঝিয়ারী নিবাসী ধর্মদাস চৌধুরী শিক্ষক হিসাবে যোগ দিলেন। অরিন্দম বাবু ও দাশরথি বাবু আই-এ পাশ ছিলেন এবং শেষোক্ত জন ছিলেন বি, এস, সি। এই সময় করুই নিবাসী ননীগোপাল মুখার্জী প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। ইংরাজী সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন ননীবাবু। চন্দ্রপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক হেমবাবু ননীবাবুর সমসাময়িক ছিলেন।
বর্ষাকালে গ্রামগুলির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। বিদ্যালয়ের দক্ষিণের গ্রামগুলি যথা কালুই, কালশ্বর, হাটগাছা, ভোজপুরের ছাত্ররা খাঁপুরের জোল পেরিয়ে আসতে পারতো না। খালে সাঁতার জল থাকতো। আবার ফুলগ্রাম বেলেন্ডার ছেলেদের কাঁদর সাঁতার কেটে আসতে হোত। মন্তেশ্বর, লোহার, সিংহালী হতে অনেক ছাত্র আসতো। পরবর্তী কালে মাষ্টার মশাইদের একটা বড় অংশ এখান হ'তেই আসতেন। বন্যার সময় মালডাঙ্গা হ'তে সতী-ঘাট (মন্তেশ্বরের প্রবেশ মুখে) নৌকা পারাপার করতো।
পঞ্চাশের দশকে যে শিক্ষকমণ্ডলীকে এই বিদ্যালয় পেয়েছিল তাদের চেয়ে স্থানীয় শিক্ষিত যুবকদের অবদান ভোলবার নয়। খাপুরের শ্রীলক্ষ্মীনারায়ণ প্রামাণিক প্রায়শঃ বিদ্যালয়ে আসতেন এবং বিনা বেতনে ক্লাস নিতেন। ঐ গ্রামের শ্রীমথুরা মোহন মণ্ডলও মাসাধিককাল অবৈতনিক ভাবে শিক্ষাদান করে গেছেন। ফুলগ্রাম নিবাসী শ্রী বিশ্বেশ্বর সোম ও বেলেন্ডার জয়ন্ত মুখার্জী বিনা বেতনে আমাদের পড়িয়ে-ছেন। বিদ্যালয়ের হাঁটি হাঁটি পা পার দিনে যাঁরা অমূল্য অবদান রেখে গেছেন তাঁদের সশ্রদ্ধভাবে স্মরণ করি।
স্কুলের পূর্বদিক দিয়ে খড়ি নদী বয়ে গেছে। তারপর উত্তর বাহিনী হয়ে বিভিন্ন আঁকাবাঁকা পথে জালুইডাঙ্গায় (সমুদ্রগড়) কাছে গঙ্গায় মিশেছে। সত্তর দশক পর্যন্ত নদী ছিল স্রোতস্বিনী। নদীতে অসংখ্য চুয়োন (মাটির তলদেশ হতে জল চুইয়ে চুইয়ে উঠতো) থাকায় বারো মাস নদীতে জল থাকতো এবং নদী ছিল নাব্য। দুশো হ'তে পাঁচশো মনের চার-পাঁচখানি নৌকা সব সময় মালডাঙ্গার ঘাটে নোঙর করে থাকতো। মালডাঙ্গা হতে নাদনঘাট মোকামে ধান বোঝাই নৌকা যাতায়াত করতো। এবং কলকাতা হ'তে পণ্যবাহী নৌকা পাল তুলে অথবা গুণটেনে মালডাঙ্গার ঘাটে নোঙর করতো। আজ স্বাভাবিক জলের উৎসগুলি শুকিয়ে যাওয়ায় নদী গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে এবং পণ্য ও যাত্রী পরিবহন বন্ধ হয়ে গেছে।
সপ্তাহে মালডাঙ্গায় দু'দিন হাট বসতো। এই হাট খুব জমজমাট ছিল। মালডাঙ্গা ছিল লেনদেনের প্রধান কেন্দ্র। মন্তেশ্বরের হাটের পত্তন অনেক পরে হয়েছে। কাঁচা আনাজ (বিশেষ করে বেগুন ও ডাঁটা) আলমপুরের হাটুরেরা বলদের পিঠে চাপিয়ে নিয়ে আসতো। এগুলিকে ছালা বলা হোত।
মালডাঙ্গার সাংস্কৃতিক দিকটিও উল্লেখ করার মতো। কিরিটি বাবুর যাত্রার দল যাত্রামোদী শ্রোতাদের কাছে বিরাট আকর্ষণ ছিল। যাত্রার কুশীলবদের অভিনয় কাটোয়া ও কালনা মহকুমার অনেক গ্রামের প্রবীণ মানুষ আজও প্রশংসা করেন। আজ হ'তে ৬০/৬৫ বৎসর পূর্বে সাধক নীলকণ্ঠ যাত্রার দল নিয়ে মালডাঙ্গা এসে ছিলেন (স্নানরত অবস্থায় পরে সাধক স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেন)। প্রচুর শ্রোতার সমাগম হয়। হৈ হট্টগোল চলতে থাকে। সাধক নীলকণ্ঠ অশান্ত জনসমুদ্রকে তাৎক্ষণিক রচিত ও সুরারো-পিত গানে শান্ত করেন। আজও প্রবীণদের মুখে সেই গানের কলি শোনা যায়-
"যাব না আর ও মালডাঙ্গা মালডাঙ্গা নয়-গোলমাল ডাঙ্গা। কত ঝড় তুফান পেরিয়ে শেষে- শুকনো ডাঙ্গায় ডুবলো ডোঙা”।