আজকাল একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় যে, দেশটা ধর্ম ধর্ম করে গেল। আসলকথা, ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে না পারার জন্যেই লোকে এরকম কথা বলে। 'ধর্ম' শব্দটি বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। লোকে ধর্ম বলতে সাধারণতঃ আচারমূলক কর্তব্যকে বুঝে থাকে। কিন্তু এটা ধর্মের গৌণ ব্যবহার। মুখ্যতঃ ধর্ম (রিলিজিয়ন) বলতে সনাতন ধর্মকে বোঝায়, যাকে সাধারণ ধর্ম বলে। বর্ণধর্ম, আশ্রমধর্ম প্রভৃতি হ'ল আচারমূলক ধর্ম। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র-এই চার প্রকার বর্ণের কর্তব্যকর্মকে বর্ণধর্ম বলে। ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস-এই চার প্রকার আশ্রমের জন্য কর্তব্য-কর্মকে আশ্রম ধর্ম বলে। হিন্দুধর্ম, মুসলিম ধর্ম, খ্রীষ্টধর্ম প্রভৃতি সবই আচারমূলক ধর্ম। এইসব আচারমূলক কর্ম নিয়মিত ভাবে অনুষ্ঠান করলে জীবনে নিয়মানুবর্তিতা আসে, জীবন সুনিয়ন্ত্রিত হ্যা এবং সনাতন ধর্ম বা সাধারণ ধর্ম বোঝার মত যোগ্যতা জন্মায়।
সাধারণ ধর্ম বা সনাতন ধর্মই ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ। ধর্ম হচ্ছে ঐকামুখী অন্বেষণ, বিভেদমুখী নয়। সকল মানুষের প্রতি প্রীতি, করুণা, মৈত্রী ধর্মের লক্ষণ। প্রীতি জন্মায়। আচারমূলক ধর্ম করলে গোষ্ঠী-আর সাধারণ ধর্মের জ্ঞান হলে সকল মানুষের প্রতি ভালবাসা জন্মায়। সকলের প্রতি ভালবাসাকেই দয়া বলে। ধর্মের সারকথা হচ্ছে, নিজের কাছে যেটি প্রতিকূল, সেটা অন্যের ক্ষেত্রে আচরণ না করা। কিংবা যেটি নিজের অনুকূল অন্যের প্রতি অনুরূপ আচরণ করা। মহাভারতের শান্তিপর্বে দেবলের কণ্ঠে ধর্মের প্রকৃতস্বরূপ বর্ণিত হয়েছে- "আত্মানঃপ্রতিকুলানি পরেষাং ন সমাচরেৎ।” আচারমূলক ধর্মের লক্ষ্য হচ্ছে, মানুষের মনকে সনাতন ধর্মের দিকে চালিত করা। দুঃখের বিষয়, আমরা দেখতে পাই, অনেক সময় আচারমূলক ধর্ম গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ঘটায়। বস্তুতঃ এটি আচারমূলক ধর্মের ত্রুটি নয়, প্রয়োগের ত্রুটি। বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠী যে বিশেষ বিশেষ কম করার উপদেশ দিয়ে থাকেন তার উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজেদের আচরণের প্রতি অটুট শ্রদ্ধাশীল হওয়া, অন্য গোষ্ঠীর আচরণের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা নয়। কিন্তু অনেক সময় এক ধর্মাবলম্বীকে অপর ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণু হতে দেখা যায়। এটি আচারমূলক ধর্মের লক্ষ্য নয়। অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করে নিজের কর্তব্যকর্ম আচরণ করলে তবেই প্রকৃত ধর্মবোধ জন্মায়। নিজের কর্তব্য কর্ম আচরণ না করা অন্য ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা নয়। নিজের কর্তব্যকর্ম ঠিকমত পালন করে অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করা বা সমভাব পোষণ করাকেই পরধর্ম সহিষ্ণুতা বলে। অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষী না হয়ে নিজের ধর্মকে শ্রদ্ধার সাথে অনুষ্ঠান করলে তবেই মানুষ সনাতন ধর্ম হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে।
সকলের প্রতি সমান মনোভাব, ভালোবাসা প্রীতি ও করুণাই হচ্ছে প্রকৃত ধর্মের স্বরূপ। অধ্যাত্মজ্ঞান ছাড়া এরকম ধর্মবোধ মনে জাগে না। ভারতবর্ষের সনাতন ঋষিরা বলেন, বিশ্বের মানুষ একই অমৃতের পুত্র। আর অদ্বৈত বেদান্তীরাও বলেছেন জীব ও ব্রহ্মের মধ্যে কোন ভেদ নেই। জীব ও জীবের মধ্যেও মূলত কোন ভেদ নেই। আজ যে সমস্ত বিশ্বে কোথাও বর্ণ-গত, কোথাও ভাষাগত, কোথাও বা ধর্মগত বিদ্বেষ দেখা দিয়েছে তার কারণ এই একত্বের জ্ঞান না থাকা। মানুষে মানুষে ভেদ নেই, সমস্ত মানুষই এক থেকে এসেছে, একেতেই লীন হবে-প্রাচীন ঋষিদের সেই মূলমন্ত্র বুঝতে পারলে তবেই মনে ধর্মবোধ জাগ্রত হবে।