দীর্ঘ পঞ্চাশ বৎসরের সেই পথ। ১৪৪৭ থেকে ১৯৯৭ এই দীর্ঘ পথের পঞ্চাশ বৎসরকে পিছনে ফেলে আজ আমরা এক ইতিহাস পূর্ণ ঐতিহ্যমণ্ডিত প্রতিষ্ঠানের সুবর্ণ জয়ন্তী ও পুনর্মিলন অনুষ্ঠানের সন্ধিক্ষণে মুখোমুখি হয়েছি। এই সুবর্ণ জয়ন্তী ও পুনর্মিলনের সমপাতিত ক্ষেত্র হয়ে উঠুক এক মহামিলন ক্ষেত্র যে সূচনার মধ্যে দিয়ে এই গৌরাবান্বিত প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠুক আরও মর্য্যাদাপূর্ণ, আরও ঐতিহ্যবাহী, রচনা করুক আরও নূতন নূতন গঠনমূলক ফলপ্রসূ ও সমৃদ্ধি সূচক ইতিহাস। আগামী দিনের প্রজন্ম সততই এখান থেকে গ্রহণ করুক প্রকৃত নিষ্ঠা, প্রকৃত শিক্ষা, হয়ে উঠুক এই প্রতিষ্ঠানের সেরা কৃতি সাক্ষী।
১৯৪৭ সালের সেই দিনটি যে দিন এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সমিতি কাছের ও পাশা-পাশি গ্রামের বাড়ীতে আগমনী বার্তা পাঠিয়ে এর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন এবং হয়তো স্বপ্ন দেখেছিলেন ভবিষ্যতে এটা একটি আদর্শ মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। ভেবে ছিলেন কিনা জানি না আজ থেকে ৫০ বৎসর পরে সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের এই ভাবনা ও চিন্তার জন্য হয়তো কারও না কারো কৌতুহল থাকবে। রবীন্দ্রনাথের ১৪০০ সাল কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা যায় 'আজি হইতে শত বৎসর পরে কে তুমি আমার কবিতা-খানি পড়িতেছো কৌতুহল ভরে'। আজ এই প্রতিষ্ঠানের সুবর্ণ জয়ন্তী ঘিরে বারে বারে সেই কৌতূহলই জাগবে।
স্কুলের পঞ্চাশ বৎসর চলার পথে আমার সৌভাগা যে দুই দুই বার এর সঙ্গ লাভ করতে পেরেছিলাম। একবার ছাত্র অবস্থায় ছয় বৎসর সঙ্গ পেয়েছিলাম। দ্বিতীয় বার এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতে এসে ২৫ বৎসর এর ধারাবাহি-কতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম। সুতরাং বলা যায় এই বিদ্যালয়ের আয়ুকালের অর্ধেকের বেশী সময় ৩১ বৎসর এর সুখ দুঃখের অংশীদার ছিলাম। আমার ছাত্র অবস্থায় বিদ্যালয়ের নূতন ছাত্র বাসের মাধ্যমে বহিরাগত বহু শিক্ষক ও ছাত্রদের সংযোগ ও সংলাপে আমি গর্ব অনুভব করি। স্কুলের তৎকালীন শিক্ষক মহাশয়গণের পঠন-পাঠন আচার-ব্যবহার, সততা, নিষ্ঠা, ভালোবাসা, সহানুভুতি ও আত্ম মর্যাদা আমাকে পরবর্তী শিক্ষকের ভূমিকায় যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ করেছে। বলতে দ্বিধা নেই আজ আমার শিক্ষকতায় যদি কোন রকম কোন স্বীকৃতি থেকে থাকে তবে আমি মনে করি ঐ স্কুল ও আমার মাষ্টার মহাশয়গণের কাছ থেকেই তা পেয়েছি। আমি তাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ। আজ শিক্ষকতা পেশায় যে টুকু ছাত্রছাত্রীদের উপকার করতে পেরেছি তার জন্য তাদেরকে স্মরণ না করাটা সত্যের অপলাপ বলে মনে করি। অবশেষে স্কুল জীবন শেষ করে ছয়টা বৎসর বাহিরে পড়াশুনা করার পর আবার এই স্কুলেই গণিতের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করে, আমার মাষ্টার মহাশয়দের সান্নিধ্য লাভ করেছিলাম। বলা যায় জীবনে এ এক চরম সৌভাগ্য। তাদের সঙ্গে থেকে স্কুলের সর্ব্বাঙ্গীন উন্নতির চেষ্টা করে গেছি। জানিনা সে কাজে কতটা সফল হতে পেরেছি। সেই বিচারের ভার আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের হাতে ছেড়ে দিয়ে গেলাম। এর পর স্কুলের একটা দুর্ভাগ্যের কথা বলি। এটা স্কুলের বরাতে একটা দুর্ঘটনাও বটে। আমার মাষ্টার মহাশয় তথা স্কুলের কর্মরত প্রধান শিক্ষক এর (Late) শ্রীযুক্ত সুধাকর গড়াই মহাশয়ের জীবনের দুরারোগ্য ব্যাধির আবির্ভাব হলো। টেনিংরত অবস্থায় ছুটে এলাম মাষ্টার মহাশয়ের বাড়ী। মৃত্যু শয্যা থেকে দুই একটা কথা এবং সেই শেষ কথা। শুধু বলে গেলেন তোমরা স্কুলের ছাত্র এর শ্রীবৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোন কার্পন্য দেখিও না। এরপর ৫ই আশ্বিন (১৩৮০) মৃত্যুকে বিদ্রূপ করে পৃথিবী থেকে অন্তর্ধান হলেন। ফেলে রেখে গেলেন অগনিত সুযোগ্য ছাত্র-ছাত্রী যাদের আচার, ব্যবহার, চালচলন ও কলমের অচিরে তিনি আজও জীবিত।
একই সুত্রধরে পরবর্তী পদক্ষেপ নতুন কাণ্ডারী শ্রীযুক্ত নিমাইচরণ মণ্ডলের আবির্ভার। বিদ্যালয়ে শিক্ষক মণ্ডলীর পরিচিতির মাধ্যমে বিদ্যালয়ে, অভিনব ভবমুর্ত্তি পঠনে ব্রতী হলেন। সেইদিন ঐ শুভ সুচনার অন্তীমকালে সহকারী প্রধান শিক্ষক সদ্য যোগদান রত প্রধান শিক্ষকের কিছু কথা, কথা হলো আর একজনার সঙ্গে আপনার পরিচয় হবে আগামী কাল, উনি আজ অনুপস্থিত। এই সময় গভীর দুঃখের সঙ্গে স্মরণ করি সেই সহকারী প্রধান শিক্ষক শ্রীযুক্ত সুবোধ কুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়কে তিনি আমার শিক্ষক ও বটে। তিনি আজ আর আমাদের মধ্যে নাই। দুর্ভাগ্য শেষটায় ওনার সঙ্গে আমি আর যোগা-যোগ করতে পারি নাই। একটা কথা না বললে ত্রুটি থেকে যায় সেটা হল এই স্কুলে তাঁর সুদীর্ঘ কর্মজীবনে সহকারী প্রধান শিক্ষকের ভূমিকা অতুলনীয়। প্রধান শিক্ষকের কাজকর্ম্মে সহ-যোগিতার হাত বাড়ানো থেকে আরম্ভ করে যে কোন গঠনমূলক ব্যাপারে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ আজও মাঝে মধ্যে আলোচনার বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। বলতে কি স্কুলের সর্ব্বাঙ্গীন উন্নতিতে ও স্কুলের প্রতি ভালোবাসায় কোন খাদ ছিল বলে মনে হয় না।
পরের দিন মেমারী মন্তেশ্বর বাসের যাত্রী হয়ে মালডাঙ্গা ফেরার পথে মধ্যমগ্রামের একই বাসে একটু তফাতে বসেছিলেন শুধু একদিনের অভিজ্ঞতার প্রধান শিক্ষক, এখানেই ঘটেছিল অচেনা অজানা সঙ্গ লাভ। কুসুমগ্রামে এসে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথোপকথনে একতরফা পরিচয় খুলে গেল, আমি বুঝে গেলাম উনিই গতদিন মালডাঙ্গা প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগ-দান করেছেন। বাস থেকে নামার সময় উভয় দিক থেকেই পরিচয় হল, সেই পরিচয় প্রাথমিক ভাবেই সমাপ্ত হলো। কিছুদিন পরে একটা পরিচয় সুস্পষ্ট হলো যে যদিও উনি এলাকার মানুষ নন বা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র নন, তবুও স্কুল এর পূর্ব্ব সূত্রধরে সর্ব্বাঙ্গীন উন্নতির চেষ্টায় খুবই আগ্রহী। এই সূত্রই সহকারী শিক্ষক ও স্কুলের অন্যান্য কর্মীদের সাথে ওনার একটা মিলন ক্ষেত্র গড়ে ওঠে। ফলে স্কুলে দেখা দেয় ঐক্যতান স্রোত। বিবিধের মাঝে মিলন ঘটে যায়। কাছের ও দূরের বিভিন্ন শিক্ষক শিক্ষিকা ছাত্র ও ছাত্রী মহামিলন ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠানকে গৌরব উজ্জল করে তুলেছিল। রবীন্দ্রনাথ তার ঐক্যতান কবিতায় বলেছিলেন 'প্রকৃতির ঐক্যতান স্রোতে নানা কবি ঢালে গান নানা দিক হতে'-প্রতিষ্ঠান যেন প্রকৃতির রূপ নেয়। সেখানেই শিক্ষক ছাত্রের দরদী আদান প্রদানের প্রতিষ্ঠান প্রকৃতির এই প্রকৃতিগত প্রতিষ্ঠানের চেহারা পায়। আশীর্ব্বাদ পুষ্ট হয়ে ছাত্রছাত্রীরা দিকে দিকে আজ স্কুলের গর্ব স্কুলের সম্পদ, এই এলাকার সুনামের ধারক ও বাহক। স্কুলের গর্বের সঙ্গে যুক্ত আমি ও একজন। দীর্ঘ ২৫ বৎসর শিক্ষকতা করার সময় এর চিন্তা ভাবনা ও ঐতিহ্নের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৯৩ সালের ফলাফলের কৃতীছাত্র শ্যামাপ্রসাদ মণ্ডলের ১৯তম স্থান (এইচ, এস, বিজ্ঞান) প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য সহকর্মীদের সহযোগিতার চূড়ান্ত ফল, তখন আমিও এর সঙ্গে যুক্ত এবং উপভোগ কারিদের মধ্যেও আমি একজন।
এর বিদায়ের সুর ১৯৯৪ সালে ১৬ই নভেম্বর বিদ্যালয় হইতে প্রস্থান ঘটে গেল, শেষ দিন শেষ মুহূর্তে সামান্য বিদায় অনুষ্ঠানটুকু সেরে প্রধান শিক্ষকের হাতে নিজের নামাঙ্কিত বোর্ড মোছার তুলিটা দিয়ে বলেছিলাম মালডাঙ্গার কাজ আমার সমাপ্ত। তারপর চোখের জলে ছাত্র ও শিক্ষক জীবনের একান্ত স্কুলটা থেকে ভেসে আসা বহু কথোপকথনকে ঠেলে আস্তে আস্তে প্রস্থান, বিদায়, স্কুল থেকে বিদায়। বাড়ি ফেরার পথে শুধু একবার মনে হয়েছিল মালডাঙ্গা আজ আমার কাছে-কি-কবে কোথায়, চলার পথে উত্তর খুঁজে পেলাম মালডাঙ্গা আজ আমার কাছে স্মৃতি, আর স্মৃতি, শুধু স্মৃতি।